ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সম্পূর্ণ জীবনী

6
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সম্পূর্ণ জীবনী

Table of Content (toc)

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবনী

"সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরনং ব্রজ ।

অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।।

                                                               -- গীতা ১৮/৬৬

" সর্বধর্ম পরিত্যাগ করি অনুক্ষণ

একমাত্র আমাকেই কর হে শরণ ।

সর্বপাপ হতে মুক্ত করিব নিশ্চয়

শোক নাহি কর তুমি ওহে ধনঞ্জয় ।।"

কে এই পরমপুরুষ যিনি জীবনকে সমস্ত পাপ থেকে উদ্ধার করার বলিষ্ঠ প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন ?  হ্যা, ইনিই শ্রীমদভগবদগীতার প্রাণপুরুষ, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ।


জন্ম ও শৈশব লীলা

ভােজ রাজবংশের রাজা কংস পিতা উগ্রসেনকে সিংহাসনচ্যুত করে মথুরায় রাজত্ব করছেন । জেঠতুতাে বােন দেবকীকে শূর বংশের বসুদেবের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন । বর কনেকে রথে করে নেওয়া হচ্ছে । রথের সারথি হয়েছেন কংস নিজে । এমন সময় আকাশে এক দৈববাণী হল-

হে নির্বোধ, যাকে তুমি রথে নিয়ে যাচ্ছ, সেই দেবকীর গর্ভের অষ্টম সন্তান তােমার প্রাণ হরণ করবে ।

দৈববাণী শুনে কংস ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন । খড়গ হাতে দেবকীকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন । বর বসুদেব সবিনয়ে কংসকে বললেন, “দেবকীকে আপনি বধ করবেন না । দেবকীর গর্ভে জন্মগ্রহণকারী সকল সন্তানকেই আপনার হাতে তুলে দেওয়া হবে । আপনি তাদের হত্যা করতে পারবেন ।” একথা শুনে কংস নিবৃত্ত হল ।

সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে কংস দেবকী ও বসুদেবকে কারাগারে রুদ্ধ করে রাখলেন । কারাগারেই একে একে দেবকীর ছয়টি সন্তানকে জন্মের পরই কংস হত্যা করলেন । সপ্তম সন্তানের সন্ধান পেলেন না । দেবকীর অষ্টম গর্ভে এলেন শ্রীকৃষ্ণ । ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথির গভীর রজনীতে শ্রীকৃষ্ণ কংসের কারাগারে জন্মগ্রহণ করলেন । সে ছিল এক ভীষণ দুর্যোগময় রজনী । প্রবল ঝড় বৃষ্টিতে প্রকৃতি ধারণ করেছে ভীষণ মূর্তি । তখন যােগমায়ার প্রভাবে প্রহরীরা হয়েছে অচেতন । দৈব নির্দেশে সদ্যোজাত পুত্রকে নিয়ে বসুদেব কারাগার থেকে বের হয়ে গােকুলে নন্দরাজ পত্নী যশােদার পাশে রাখলেন এবং তার নবজাত কন্যাকে নিয়ে এসে দিলেন দেবকীর কোলে ।

পরদিন ভােরে দেবকীর গর্ভের অষ্টম সন্তানকে বধ করার জন্য কারাগারে ছুটে এলেন কংস । দেবকীর কাকুতি মিনতি অগ্রাহ্য করে তিনি শিশু কন্যাটিকে আছাড় মারবার জন্য যেই তুলেছেন, অমনি সে উধ্বদিকে চলে যেতে যেতে বলে গেল

-“কংস, তােমাকে বধ করবার জন্য নারায়ণ জন্মগ্রহণ করেছেন ।”-একথা শুনে কংস মৃত্যুর আশঙ্কায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন । কংস সিদ্ধান্ত নিলেন মথুরার সমস্ত শিশুদের হত্যা করা হবে । পাঠালেন তিনি পুতনা রাক্ষসীকে ।

বিষাক্ত স্তন পান করিয়ে পুতনা অনেক শিশুকে নিহত করল । কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ এই পুতনার স্তন এমন কঠোরভাবে পান করেন যে যন্ত্রণায় পুতনা তৎক্ষণাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হয় । এই সংবাদে কংস বুঝতে পারেন, কৃষ্ণই তাঁর প্রধান শত্রু ।


কংস বধ

যতই দিন যাচ্ছে ততই শ্রীকৃষ্ণের প্রতি কংসের আক্রোশ বৃদ্ধি পাচ্ছে । শেষে তিনি অক্রুরকে পাঠালেন শ্রীকৃষ্ণের কাছে । অক্রুর শ্রীকৃষ্ণকে কংসের নিমন্ত্রণ ও গুপ্ত অভিসন্ধির কথা জানান । কৃষ্ণ ও বলরাম নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে মথুরায় যান । মল্লযােদ্ধারা শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয় । কিন্তু না, তারা এদের সামনে টিকতে পারল না, কৃষ্ণ ও বলরামের হাতে তারা পরাজিত ও নিহত হয় । এই ভীষণ দৃশ্য দেখার পর কংস ক্রোধে ও ক্ষোতে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লেন । তিনি মল্লক্ষেত্রে উপস্থিত নন্দ, বসুদেব এবং পিতা উগ্রসেনকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে নির্দেশ দিলেন । কংসের এ আদেশ শুনে শ্রীকৃষ্ণ আর বিলম্ব করলেন না । কংসের মঞ্চে লাফিয়ে উঠে তাকে চুল ধরে মাটিতে নামালেন এবং সেখানেই তাকে হত্যা করলেন । এরপর শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম দেবকী-বসুদেবসহ অন্যান্য ব্যক্তিদের মুক্ত করেন এবং কংসের পিতা উগ্রসেনকে মথুরার রাজপদে বরণ করেন । এরপর শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম মথুরায় পিতা মাতার সঙ্গে বাস করতে থাকেন ।

জরাসন্ধ ও শিশুপাল বধ

অত্যাচারী রাজা কংস নিহত হলেও মানুষের জীবনে শান্তি আসছে না । কংসের শ্বশুর জরাসন্ধ শ্রীকৃষ্ণের উপর ভীষণ রেগে গেলেন । শ্রীকৃষ্ণকে বিনাশ করার ইচ্ছায় বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে তিনি মথুরা আক্রমণ করলেন । শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম অল্প শক্তি নিয়ে দৈব অস্ত্রের সহায়তায় জরাসন্ধের বাহিনীকে পরাস্ত করে তাকে বন্দী করলেন । বলরাম জরাসন্ধকে হত্যা করতে যাচ্ছিলেন । কৃষ্ণ তাঁকে সেবারের মত ছেড়ে দিলেন ।

এ ঘটনায় জরাসন্ধ লজ্জাবােধ করলেন বটে কিন্তু পরাজয়ের গ্লানিতে পর পর সাত বার তিনি মথুরা আক্রমণ করলেন ।

পরে শ্রীকৃষ্ণের সিদ্ধান্তে ভীম জরাসন্ধকে বধ করলেন ।

এবার শিশুপালের পালা ।

যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে ভীষ্ম কৃষ্ণকে অর্থ প্রদান করেন । এতে চেদিরাজ শিশুপাল ঈর্ষান্বিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণের নিন্দা করতে শুরু করেন । এ পর্যন্ত শ্রীকৃষ্ণ শিশুপালের শত অপরাধ মার্জনা করে তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেন । এই বার তিনি সুদর্শন চক্ৰদ্বারা শিশুপালের শিরচ্ছেদ করলেন ।


কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ ও ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা

কংস, জরাসন্ধ, শিশুপাল ও তাদের অনুগামী কয়েক জন অত্যাচারী রাজার বিনাশ ঘটলেও তখনও বেশ কিছু স্বার্থান্বেষী লােভী অত্যাচারী রাজা রয়ে গেছেন । এঁদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাসম্পন্ন ধৃতরাষ্ট্র ও তার দুর্যোধনাদি শত পুত্র রাজ্য লােভে এক সময় অত্যন্ত গর্হিত কর্মে লিপ্ত হয়েছিলেন । পাণ্ডু ও ধৃতরাষ্ট্র ছিলেন দুই ভাই । ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ বলে ছােট ভাই পাণ্ডু রাজা হন । পাণ্ডুর মৃত্যুর পর পঞ্চপাণ্ডবেরই রাজ্য প্রাপ্য । কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র ধর্মাধর্ম বিচার না করে নিজ পুত্রকে সমর্থন করলেন এবং পাণ্ডবদের কোন অনিষ্ট করতে না পারায় শেষ পর্যন্ত তিনি রাজ্য দু ভাগ করে দুর্যোধন ও যুধিষ্ঠিরকে প্রদান করলেন । ইন্দ্রপ্রস্থ হল পাণ্ডবদের নতুন রাজধানী ।

অর্ধেক রাজ্যের অধিপতি হয়েও দুর্যোধন মােটেই খুশি নন । গােটা রাজ্যটা তার চাই। কপট পাশা খেলায় পাণ্ডবদের হারিয়ে বার বছরের জন্য বনবাসে এবং এক বছর অজ্ঞাতবাসে পাঠালেন । শর্ত হল, তের বছর পর পাণ্ডবগণকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে তাদের রাজ্য ।


পাণ্ডবগণ ছিলেন ধর্মপরায়ণ । পূর্ব শর্তানুযায়ী পাণ্ডবগণ বনবাস জীবনের পরে দুর্যোধনের নিকট তাদের রাজ্য ফিরে চাইলেন । কিন্তু অতি লােভী দুর্যোধন পাণ্ডবদেরকে ‘সূচাগ্র মেদিনী’ দিতে সম্মত নন । এতে পাণ্ডবগণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন । শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শ চাইলেন তাঁরা । শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে পাণ্ডবদের রয়েছে আত্মীয়তার সম্বন্ধ । এ ছাড়া অর্জুন হলেন শ্রীকৃষ্ণের সখা । দুর্যোধন ও ধৃতরাষ্ট্রের সব রকম অন্যায়ের কথা ছিল তার জানা । পাণ্ডবদের পক্ষ হয়ে তিনি গেলেন দুর্যোধনের নিকট । উদ্দেশ্য আলােচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা । কিন্তু না, দুর্যোধনের অনমনীয় মনােভাবের ফলে শ্রীকৃষ্ণের চেষ্টা সফল হল না। ফলে কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠল । কুরুক্ষেত্র নামক স্থানে যুদ্ধ হল । এই ভীষণ যুদ্ধে উভয় পক্ষের বহু লােক, বহু রাজা ও যােদ্ধা নিহত হলেন। যুদ্ধ শেষে ধর্মপ্রাণ পান্ডবগণ রাজ্য শাসনের ভার পেলেন । অশ্বমেধ যজ্ঞ করে নিজেদের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করলেন ।


শ্রীমদ্ভগবদগীতা

ধর্মরাজ্য সংস্থাপনে শ্রীকৃষ্ণের গৌরবময় ভূমিকা স্মর্তব্য । তবে সম্ভবত শ্রীকৃষ্ণের শ্রেষ্ঠ অবদান হচ্ছে তার মুখনিঃসৃত বাণী যা পুস্তকাকারে নাম হয়েছে শ্রীমদ্ভগদ্গীতা । কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক পূর্বক্ষণে পাণ্ডবদের সেনাপতি অর্জুন হঠাৎ তার রথের সারথি শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, “আমি যুদ্ধ করব না, যুদ্ধ করলে আত্মীয়-স্বজন, পিতামহ ভীষ্ম, গুরুদেব দ্রোণাচার্য প্রমুখ পূজনীয় ব্যক্তিদেরকে হত্যা করতে হবে । এছাড়া উভয়পক্ষের রাজন্যবর্গ, সৈন্য সামন্ত নিহত হলে দেশ ও সমাজের প্রভূত অকল্যাণ হবে । এটি হবে অধর্মাচরণ; সুতরাং আমি যুদ্ধ করব না ।”

শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করানাের ইচ্ছায় ধর্মের সারকথা তুলে ধরলেন । তিনি বললেন, “দেখ অর্জুন, তুমি জ্ঞানবান, শ্রেষ্ঠ বীর, তুমি জীবনে শ্রেয় লাভ করতে যাচ্ছ, জীবনের পরম উদ্দেশ্য হচ্ছে ঈশ্বর প্রাপ্তি । যুদ্ধ করেও তুমি ভগবানের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে । তুমি সর্বতােভাবে একমাত্র ভগবানের শরণ লও। তিনি তােমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করবেন ।”

শ্রীকৃষ্ণ যে স্বয়ং ভগবান অর্জুনকে এ কথা বুঝানাের জন্য তিনি তার বিশ্বরূপ দর্শন করালেন। অর্জুনের মােহ দূর হল । তিনি যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন এবং জয়লাভ করলেন । শ্রীকৃষ্ণের এই উপদেশ বাণীর মধ্যে রয়েছে সনাতন ধর্মের সার কথা ।

অন্তর্ধান

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষে শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকায় ফিরে যান । দ্বারকায় দীর্ঘদিন রাজত্ব করেন শ্রীকৃষ্ণ । বলরাম ধ্যানযােগে দেহ ত্যাগ করলে শ্রীকৃষ্ণও নশ্বর দেহ ত্যাগ করার সংকল্প করেন । বনে প্রবেশ করে একটি অশ্বথ বৃক্ষের তলে বসে আছেন শ্রীকৃষ্ণ, এমন সময় জরা নামক এক ব্যাধ দূর থেকে ভূমিতে উপবিষ্ট কৃষ্ণকে মৃগ মনে করে তাঁর চরণ শরবিদ্ধ করল । এই শরাঘাতে শ্রীকৃষ্ণ ইহলীলা সংবরণ করেন ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

6 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
  1. শ্রীকৃষ্ণের 24 জন সখার নাম জানতে চাইছি।দয়া করে বলবেন

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. ২৪ জন সখীর নাম আমাদের সংগ্রহে নেই । আমরা অষ্টসখীর নামগুলো বলছিঃ
      ললিতা সখী, বিশাখা সখী, চম্পকলতা সখী, চিত্ৰা সখী, তুঙ্গবিদ্যা সখী, ইন্দুলেখা সখী, রঙ্গদেবী সখী, সুদেবী সখী

      মুছুন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
To Top